ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ: পারমাণবিক ছায়ায় ক্রমবর্ধমান সংঘাত

- আপডেট সময় ০৫:৪৭:১০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৯ মে ২০২৫
- / 60
২০২৫ সালের মে মাসে, কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, যা পূর্ণাঙ্গ সংঘর্ষের দিকে ধাবিত হচ্ছে। গত ২২ এপ্রিল পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন পর্যটকের মৃত্যুর পর ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করে এবং ‘অপারেশন সিন্দুর’ নামে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে সামরিক অভিযান চালায়। এর জের ধরে উভয় পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা শুরু হয়েছে, যা বহু বেসামরিক ও সেনা সদস্যের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।
ভারত অভিযোগ করেছে, পাকিস্তানি গোলায় তাদের ১৬ জন নাগরিক নিহত হয়েছে, অন্যদিকে পাকিস্তানের দাবি, ভারতীয় হামলায় তাদের ৩১ জন বেসামরিক লোক মারা গেছে। উভয় দেশই একে অপরের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে মদদ দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে। এই সংঘাত শুধু দ্বিপাক্ষিক নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ।
বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৫ সালের এপ্রিল-মে মাস দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে এক অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘাতের সূচনা হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। পহেলগামের সন্ত্রাসী হামলা, ভারতের প্রতিশোধমূলক বিমান অভিযান এবং পাকিস্তানের পাল্টা গোলাবর্ষণ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর কাশ্মীর নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একাধিকবার যুদ্ধ হয়েছে, এবং এই নতুন সংঘাত সেই রক্তাক্ত ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি বলেই মনে করা হচ্ছে।
উভয় দেশই পরমাণু শক্তিধর হওয়ায় এই সংঘাত আঞ্চলিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। সামরিক বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, ভারত-পাকিস্তান পরমাণু যুদ্ধে জড়ালে পাঁচ কোটির বেশি মানুষের তাৎক্ষণিক মৃত্যু হতে পারে।
ভারত ইতোমধ্যে ইন্দাস পানি চুক্তি স্থগিত করার ইঙ্গিত দিয়েছে, যা পাকিস্তানকে ‘অদৃশ্য যুদ্ধের’ হুমকির মুখে ফেলেছে। ১৯৬০ সালের এই চুক্তিটি টিকে থাকলেও, এর স্থগিতাদেশ পাকিস্তানের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে ধস নামাতে পারে।
অন্যদিকে, গভীর অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত পাকিস্তান। যুদ্ধ শুরু হলে তাদের অর্থনীতি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ভারতের অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থাকলেও, দীর্ঘমেয়াদী সামরিক খরচ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা তাদেরও ক্ষতির মুখে ফেলতে পারে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও সৌদি আরব উভয় পক্ষকে সংযমের আহ্বান জানিয়েছে। তবে, চীনের পাকিস্তানের প্রতি ঐতিহ্যগত সমর্থন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহারের কৌশল এই অঞ্চলের কূটনীতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
বাংলাদেশ সরাসরি এই সংঘাতে জড়িত না থাকলেও এর প্রভাব সুস্পষ্ট। ভারতের অভ্যন্তরীণ সংকট বা নীতি পরিবর্তন বাংলাদেশের অর্থনীতি, শ্রমবাজার ও নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করতে পারে। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতি বাড়াতে পারে এবং রেমিট্যান্স ও রপ্তানি কমতে পারে। আঞ্চলিক সংস্থাগুলোর কার্যকারিতা আরও প্রশ্নের মুখে পড়বে।
এই সংঘাতের মূল ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ, যারা শান্তি, কর্মসংস্থান ও উন্নত জীবন চায়। রাজনৈতিক নেতাদের আবেগপ্রবণতা হয়তো সাময়িক সুবিধা দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা জাতির জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, চূড়ান্ত সমাধান আসে আলোচনার মাধ্যমেই।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের নাগরিকদের দায়িত্বশীল আচরণ করা জরুরি। সামাজিক মাধ্যমে বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য বা উসকানিমূলক তথ্য প্রচার করা যেমন অনৈতিক, তেমনি দেশের জন্যও বিপজ্জনক। আমাদের মনে রাখতে হবে, এই সংঘাতের অভিঘাত বাংলাদেশেও বহুবিধ হতে পারে—অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নিরাপত্তাগত দিক থেকে।
বাংলাদেশের জন্য এই মুহূর্তে প্রয়োজন একটি নিরপেক্ষ, দূরদর্শী ও প্রস্তুতিমূলক অবস্থান। পররাষ্ট্রনীতিতে শান্তির বার্তা স্পষ্ট করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে আলোচনার পরিবেশ তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। সীমান্ত ও নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রস্তুত রাখা এবং গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্য রোধে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। ধৈর্য, সংযম ও সময়োপযোগী কৌশলই হবে এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। বাংলাদেশকে শান্তির পক্ষে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার পক্ষে একটি নির্ভরযোগ্য শক্তি হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করতে হবে।
ভারত ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এখন পরিণত মনোভাব, সাহসী শান্তির বার্তা এবং আলোচনাপূর্ণ সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। যুদ্ধ নয়, কূটনীতিই ভবিষ্যতের একমাত্র পথ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ধ্বংস ও বিভেদ রেখে যাওয়া একটি ব্যর্থ প্রজন্মের পরিচয় বহন করবে। তাই এই উত্তপ্ত সময়ে সবচেয়ে জরুরি বার্তা—শান্তি চাই, যুদ্ধ নয়।