শিক্ষার্থীদের দাবি: প্রতিবাদের পথ নির্বাচন করুন, জনগণকে নয়

- আপডেট সময় ১০:৫৬:৫৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৫
- / 28
বাংলাদেশের প্রশাসনিক সংস্কৃতিতে দীর্ঘসূত্রতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতা যেন একটি স্থায়ী বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ প্রায়শই নাগরিকদের ন্যায্য দাবি ও সমস্যার প্রতি ততক্ষণ পর্যন্ত নির্লিপ্ত থাকে, যতক্ষণ না পরিস্থিতি চূড়ান্ত সংকটে রূপ নেয়। পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের চলমান ছয় দফা দাবি ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতিও এই চিত্রেরই প্রতিফলন।
প্রায় সাত মাস ধরে বিভিন্ন বৈধ উপায়ে দাবি জানিয়ে আসার পরও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনীহা ও সময়োপযোগী সংলাপের ঘাটতি শিক্ষার্থীদের রাজপথে নামতে বাধ্য করেছে। তবে আন্দোলনের ধরন নিয়েও আমাদের চিন্তা করা প্রয়োজন। বিশেষ করে গত বুধবার রাজধানীর তেজগাঁও সাতরাস্তা মোড়ে শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ যে ভয়াবহ জনদুর্ভোগ তৈরি করেছে, তা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
ঢাকা এমনিতেই প্রতিদিন তীব্র যানজটের কবলে থাকে। এর মধ্যে নগরীর কেন্দ্রস্থলে রাস্তা অবরোধ করে বসা মানে স্বাভাবিক জনজীবন পুরোপুরি থামিয়ে দেওয়া। ওই দিন ছিল এসএসসি পরীক্ষা, কেউ ছুটছিলেন হাসপাতালে, কেউ যাচ্ছিলেন ভর্তি বা চাকরির পরীক্ষায়—সব কার্যক্রমই প্রায় অচল হয়ে পড়ে। অনেকেই গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেননি, অনেকে বাধ্য হয়েছেন পথ থেকে ফিরে যেতে।
এই পরিস্থিতি শুধু রাজধানী নয়, দেশের অন্যান্য শহরেও প্রতিফলিত হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় সড়ক অবরোধ কর্মসূচির পাশাপাশি রেলপথও অবরোধের পরিকল্পনা ছিল, যা পরে শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরারের হস্তক্ষেপে স্থগিত হয়। কিন্তু পরদিন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের সঙ্গে আলোচনায়ও কোনো কার্যকর সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি। শিক্ষার্থীরা সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তারা সন্তুষ্ট নয় এবং আন্দোলনে ফিরে যাবে।
এখানেই সরকারের ব্যর্থতা সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। যদি দাবিগুলো যৌক্তিক হয়, তবে সরকারকে তা মেনে নেওয়ার সাহস দেখাতে হবে—বাস্তবায়নের রূপরেখা ও সময়সূচি দিতে হবে। আর যদি দাবি বাস্তবায়নে সময় লাগে কিংবা কিছু দাবি অযৌক্তিক হয়, তা–ও শিক্ষার্থীদের কাছে স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করে একটি সম্মানজনক সমঝোতায় পৌঁছানো সরকারের দায়িত্ব। সংকটকে ঝুলিয়ে রাখা, এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল গ্রহণ করা শুধু পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেও দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশিত। আন্দোলন হোক যৌক্তিক, কিন্তু তার পন্থা হতে হবে সংযমী ও সংবেদনশীল। জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে দাবি আদায়ের চেষ্টা করলে জনসম্পৃক্ততা যেমন কমে, তেমনি হারায় সাধারণ মানুষের সহানুভূতিও। বিকল্প ও সৃজনশীল পন্থায় আন্দোলনের মাধ্যমে একই দাবিগুলোর পক্ষে জনমত গঠন সম্ভব—যেমন সংবাদ সম্মেলন, নির্ধারিত জায়গায় অবস্থান কর্মসূচি কিংবা প্রতীকী অনশন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, সরকার ও নাগরিক—উভয় পক্ষের মধ্যেই দরকার সহনশীলতা, দূরদৃষ্টি ও আন্তরিকতা। ছাত্রদের দাবি যাতে সংঘাতে রূপ না নেয়, সেদিকে নজর দেওয়া সবার দায়িত্ব। কারিগরি শিক্ষাকে ঘিরে একটি দীর্ঘমেয়াদি, সময়োপযোগী এবং সুসমন্বিত নীতিমালা এখন সময়ের দাবি। এই নীতিমালায় শিক্ষার মানোন্নয়ন, ডিপ্লোমা ও ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রির স্বীকৃতি, ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানের দিকনির্দেশনা থাকতে হবে।
অবশেষে বলা যায়, সরকারকে হতে হবে গণমুখী ও আন্তরিক, আর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ভাষা হতে হবে মানবিক ও প্রগতিশীল। যৌক্তিক দাবির দ্রুত সমাধানে উভয় পক্ষের আন্তরিক অংশগ্রহণেই সংকট নিরসনের পথ তৈরি হতে পারে।