আত্মরক্ষার ছদ্মবেশে আগ্রাসন: জাতিসংঘ সনদের ধারা ৫১, সভ্যতার সংঘর্ষ ও মুসলিম বিশ্বের উপর ভূরাজনৈতিক আগ্রাসন।

- আপডেট সময় ০৪:১৪:২০ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৫ জুন ২০২৫
- / 14
আন্তর্জাতিক রাজনীতি এক জটিল ভারসাম্যের খেলা, যেখানে শক্তির সংজ্ঞা এবং ন্যায়ের ব্যাখ্যা বহুবার পরস্পরবিরোধী হয়েছে। জাতিসংঘ গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা, যুদ্ধ বন্ধ, মানবাধিকার রক্ষা এবং আন্তর্জাতিক আইন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। জাতিসংঘ সনদের ৫১ নম্বর ধারা এই কাঠামোরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা আত্মরক্ষার অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই ধারা আজ বিশ্ব রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি অপব্যবহৃত একটি আইনি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের দ্বারা, যাদের ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্য ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কৌশলে এ ধারাটি ব্যবহৃত হয়েছে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে আগ্রাসনের বৈধতা তৈরি করার জন্য।
আন্তর্জাতিক আইন, বিশেষত জাতিসংঘ সনদের ৫১ নম্বর ধারা, আত্মরক্ষার অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু এই ধারা আজ বিশ্বরাজনীতিতে একটি এমন অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যার মাধ্যমে একতরফাভাবে সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে নিরীহ জনগোষ্ঠীর ওপর দুর্ভোগ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল এই ধারাটিকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর বিরুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপের বৈধতা তৈরি করার জন্য। অথচ জাতিসংঘের গঠনের পেছনে উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বশান্তি ও মানবাধিকারের সংরক্ষণ। বাস্তবে এই সংস্থা ধীরে ধীরে একটি পক্ষপাতদুষ্ট মডেল হয়ে উঠছে, যেখানে নির্দিষ্ট শক্তিশালী রাষ্ট্রের স্বার্থই অগ্রাধিকার পায় এবং আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের আদর্শ ক্ষীণ হয়ে যায়।
জাতিসংঘ সনদের ধারা ৫১ অনুযায়ী, যদি কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র হামলা সংঘটিত হয়, তবে সেই রাষ্ট্র স্বতন্ত্রভাবে অথবা তার মিত্রদের সাথে মিলে আত্মরক্ষার পদক্ষেপ নিতে পারে, যতক্ষণ না জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এই ধারা মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বশান্তি নিশ্চিত করতে প্রতিক্রিয়াশীল আত্মরক্ষার নীতিমালা হিসেবে যুক্ত হয়েছিল। কিন্তু আধুনিক ভূরাজনীতিতে এটি অনেক সময় প্রিম্পটিভ স্ট্রাইকের (Preemptive Strike) ছদ্মাবরণে রূপ নিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণ করে দাবি করেছিল যে ইরাকের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে এবং সেই অস্ত্র মার্কিন স্বার্থের জন্য হুমকি স্বরূপ। বাস্তবে পরে প্রমাণিত হয় যে ইরাকে কোনো WMD ছিল না, এবং গোটা যুদ্ধ একটি ভূ-রাজনৈতিক প্রতারণার ফল ছিল।
হান্টিংটনের “Clash of Civilizations?” (1993) তত্ত্ব এখানে গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে ঠান্ডা যুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বে সংঘাতের প্রধান উৎস হবে সংস্কৃতি ও সভ্যতার পার্থক্য। তাঁর মতে, ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার মধ্যে দ্বন্দ্ব অনিবার্য, কারণ উভয়ের মূল্যবোধ, সমাজ কাঠামো ও বিশ্বাস পদ্ধতির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। এই তত্ত্ব অনেক সময় রাজনৈতিকভাবে অপব্যবহৃত হয়েছে পশ্চিমা বিশ্বে ইসলাম-ভিত্তিক রাষ্ট্রগুলোকে “অপর” হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য এবং সামরিক হস্তক্ষেপকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ভূরাজনীতিতে ‘Realism’ তত্ত্ব বলে — রাষ্ট্রগুলো সর্বদা নিজেদের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়, আইন বা নৈতিকতা নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল এই তত্ত্বের নিখুঁত বাস্তবায়ন করেছে। তাদের দৃষ্টিতে ‘জাতীয় নিরাপত্তা’ এবং ‘অস্তিত্বের অধিকার’ এমন এক ছায়া, যা কখনোই পরিমাপযোগ্য নয়, ফলে তা যে কোনো সময় ব্যবহার করে আক্রমণ চালানো যায়। অথচ বিশ্ব রাজনৈতিক শিষ্টাচারে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব আছে — ‘Liberal Institutionalism’, যেখানে বলা হয় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে শৃঙ্খলা ও ন্যায় নিশ্চিত করা সম্ভব। জাতিসংঘ সেই উদ্দেশ্যে গঠিত হলেও বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় তা এক প্রহসনে পরিণত হয়েছে।
আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরান — একের পর এক মুসলিম দেশকে লক্ষ্য করে এই তত্ত্ব ও Article 51-এর অপব্যবহার করে সামরিক আগ্রাসন চালানো হয়েছে। আফগানিস্তানে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পরে যুক্তরাষ্ট্র তালেবান উৎখাতের নামে একটি ২০ বছরের যুদ্ধ শুরু করে, যা শেষ হয় তালেবানের পুনঃউত্থান ও যুক্তরাষ্ট্রের বিফলতা দিয়ে। ইরাকের যুদ্ধ শুধুই রাজনৈতিক নয়, বরং একটি সভ্যতা যুদ্ধের (Civilizational Confrontation) রূপ নেয়, যেখানে পশ্চিমা গণতন্ত্র ও “বাঁচানোর” নামে ইসলামী রাজনৈতিক কাঠামো ধ্বংস করা হয়। আরব বসন্তের সময়ে লিবিয়া ও সিরিয়ার মতো রাষ্ট্রগুলোতে যে ‘গণতান্ত্রিক বিপ্লব’ নামে হস্তক্ষেপ করা হয়, তা আসলে ছিল ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের কৌশল। সেখানে NATO ও যুক্তরাষ্ট্র Article 51 কিংবা Responsibility to Protect (R2P) ব্যবহার করে মানবতার নামে সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে দেয়, যা শেষ পর্যন্ত ওই অঞ্চলের জন্য দুর্যোগ হয়ে দাঁড়ায়।
ইসরায়েলের ভূমিকাও সমানভাবে চরম মাত্রার অপব্যবহারে পূর্ণ। ফিলিস্তিনের অব্যাহত দমন, ভূমি দখল, গাজায় বোমাবর্ষণ এবং লেবাননে হিজবুল্লাহকে আক্রমণের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা Article 51-এর “অস্তিত্বগত হুমকি” ব্যাখ্যা করে নিজেদের আগ্রাসনকে আত্মরক্ষার দাবি করে। ২০২৫ সালে যখন ইরান থেকে কথিত হামলার আশঙ্কায় ইসরায়েল তেহরানের কাছে ড্রোন হামলা চালায়, তা Article 51-এর আওতায় আত্মরক্ষার দাবি করেই বৈধতা দেয়। অথচ আন্তর্জাতিক আইনে এটি ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি, কারণ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এই বিষয়ে কোনো অনুমোদন দেয়নি এবং ইরান তখনও সশস্ত্র হামলা চালায়নি। এটা প্রমাণ করে যে ‘Imminent Threat’ ধারণাটি অস্পষ্ট ও রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের যোগ্য বলে বিবেচিত হচ্ছে। হান্টিংটনের তত্ত্বে বলা হয়েছিল, ইসলাম ধর্ম একমাত্র ধর্ম যার অনুসারীরা ‘সুশৃঙ্খল, আত্মপরিচয় সচেতন ও ঐতিহাসিকভাবে সংঘাতে জড়িত’। এই বর্ণনা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ভূরাজনৈতিক বিবরণে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবে পুনরাবৃত্তি ঘটে, যা মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধী বানিয়ে তুলে ধরতে সাহায্য করে। এই বাস্তবতায় জাতিসংঘের ব্যর্থতা আরও প্রকট। নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র একচেটিয়া ভাবে ইসরায়েলের পক্ষে ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করে চলে, ফলে ফিলিস্তিন ও অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধগুলো আন্তর্জাতিকভাবে বিচারযোগ্য হয় না। অথচ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) ফিলিস্তিনে তদন্ত শুরু করলে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল এই আদালতের বিচার মান্য করতে অস্বীকৃতি জানায়। এটা স্পষ্ট যে Article 51 ও আন্তর্জাতিক আইনের অন্য ধারাগুলো আজ একটি পক্ষপাতদুষ্ট ব্যবস্থার অংশ, যেখানে শক্তির মালিকরাই নিয়ম তৈরি ও ভঙ্গের ক্ষমতা রাখে।
এখনকার বিশ্বব্যবস্থায় “Rules-based International Order” কথাটি বারবার শোনা যায়। কিন্তু এটি কাদের জন্য? যখন রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করে তখন Article 51 বৈধ নয় বলা হয়, অথচ যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েল যখন মুসলিম দেশে আগ্রাসন চালায় তখন সেটি আত্মরক্ষার অধিকার বলে প্রচার পায়। এই দ্বিচারিতা আন্তর্জাতিক আইন ও ন্যায়বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং বিশ্বব্যবস্থায় আইনগত শূন্যতা সৃষ্টি করে। হান্টিংটনের তত্ত্বে ‘ইসলামিক কনফুসিয়ন সংঘর্ষ’, ‘ইসলামিক র্যাডিকালাইজেশন’, ‘অন্য সভ্যতার প্রতি অবিশ্বাস’ ইত্যাদি যে ভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল, তা এখন পশ্চিমা মিডিয়া ও কূটনৈতিক ভাষায় প্রতিফলিত হয়। ফলে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে কেবল সামরিক নয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে পৃথক ও হুমকি স্বরূপভাবে উপস্থাপন করা হয়। এটি একটি বৈশ্বিক শত্রু তৈরির প্রক্রিয়া, যার ভিত্তি রাষ্ট্র নয়, বরং ধর্ম, সংস্কৃতি ও বিশ্বাস। এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন ওঠে — জাতিসংঘ কি সত্যিই বিশ্বমানবতার রক্ষাকর্তা, নাকি এটি কেবলমাত্র একটি ভূ-রাজনৈতিক টুলসেট, যা বড় শক্তিগুলোর স্বার্থ রক্ষা করে চলে? ফিলিস্তিনে শিশু হত্যা, গাজায় স্কুলে বোমাবর্ষণ, সাংবাদিকদের টার্গেট করা, হাসপাতালের উপর ড্রোন হামলা — এসব কিছুই যখন “আত্মরক্ষা”র নামে বৈধতা পায়, তখন তা শুধুই Article 51-এর অপব্যবহার নয়, বরং আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের চরম অবমূল্যায়ন।
পরিশেষে, যদি Article 51-এর মতো ধারাগুলো আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষার জন্য নয়, বরং আগ্রাসনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তবে জাতিসংঘ ও এর সনদপত্রের গ্রহণযোগ্যতা ধীরে ধীরে ধসে পড়বে। এটা শুধু মুসলিম বিশ্বের জন্য নয়, বরং সমগ্র বিশ্বব্যবস্থার জন্য একটি বিপর্যয়ের সংকেত। বিশ্বের শান্তিকামী জনগণের এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর উচিত Article 51-এর ব্যাখ্যার সীমা নির্ধারণ করা, হান্টিংটনের মতো সাংস্কৃতিক পক্ষপাতদুষ্ট তত্ত্বগুলোকে পর্যালোচনা করা এবং আন্তর্জাতিক আইনকে শক্তির নয়, ন্যায়ের ভিত্তিতে প্রয়োগ নিশ্চিত করা।