তীব্র গরমে যে সমস্ত রোগের ঝুঁকি বাড়ে

- আপডেট সময় ০১:৩৭:১৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ১১ জুন ২০২৫
- / 30
প্রচণ্ড গরম বা তাপপ্রবাহ শুধু অস্বস্তি তৈরি করে না, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে নানান ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি। বাংলাদেশে মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত গরমের তীব্রতা বেশি থাকে এবং এই সময়টিতে দেখা দেয় নানা মৌসুমি অসুস্থতা। বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক ও অসুস্থ ব্যক্তিরা এসব সমস্যায় সহজে আক্রান্ত হন। হিট স্ট্রোক থেকে শুরু করে পানিশূন্যতা, ত্বকের সংক্রমণ, খাদ্যে বিষক্রিয়া সবই এই সময় দেখা দেয়। আজকের প্রতিবেদনে থাকছে তীব্র গরমে যেসব সাধারণ কিন্তু ভয়াবহ রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায় তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা। সতর্ক থাকলে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে এসব রোগ এড়ানো সম্ভব।
১. হিট স্ট্রোক: প্রাণঘাতী গরমের প্রভাবঃ
হিট স্ট্রোক গরমের সবচেয়ে বিপজ্জনক ও প্রাণঘাতী পরিণতি। যখন শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে যায় (৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি), এবং শরীরের স্বাভাবিক ঘাম নির্গত হওয়ার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়, তখন হিট স্ট্রোক হয়। এতে মাথা ঘোরা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, ত্বক শুকিয়ে যাওয়া, খিঁচুনি বা এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। গরমে রোদে কাজ করা মানুষ, শ্রমিক, শিশু ও বয়স্করা বেশি ঝুঁকিতে থাকে। এটি একটি মেডিকেল ইমার্জেন্সি, তাই দ্রুত ঠান্ডা পরিবেশে স্থানান্তর ও চিকিৎসা জরুরি। রোদে দীর্ঘক্ষণ না থাকা এবং প্রচুর পানি পান করাই এর প্রধান প্রতিরোধ ব্যবস্থা।
২. পানিশূন্যতা (Dehydration): নীরব ঘাতকঃ
তীব্র গরমে শরীর ঘাম হয়ে প্রচুর পানি ও লবণ হারায়, যা পূরণ না হলে ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা ঘটে। এই অবস্থা হলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে, মাথা ঘোরায়, প্রস্রাব কমে যায় এবং মুখ শুকিয়ে আসে। পানিশূন্যতা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তবে তা কিডনির ক্ষতিসহ নানা জটিলতায় পরিণত হতে পারে। শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে এটি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। তাই দিনে অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি, ফলের রস বা লবণ-চিনি মেশানো পানীয় খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। অতিরিক্ত চা-কফি বা কার্বনেটেড পানীয় এড়িয়ে চলা উত্তম। শরীরের আর্দ্রতা ধরে রাখাই গরমের বড় চ্যালেঞ্জ।
৩. হিট র্যাশ ও ঘামাচি: ত্বকের সমস্যা বাড়েঃ
গরমে অতিরিক্ত ঘামের কারণে ত্বকের ঘর্মগ্রন্থি বন্ধ হয়ে গিয়ে ফুসকুড়ি বা ঘামাচি হতে পারে। শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়। ঘাড়, পিঠ, বগল ও বুকে ছোট ছোট লালচে ফুসকুড়ি হয় যা চুলকায় ও জ্বালাপোড়া করে। দীর্ঘ সময় ঘামে ভেজা জামাকাপড় পরে থাকলে এই সমস্যা আরও বেড়ে যায়। প্রতিকার হিসেবে সুতির হালকা ও ঢিলেঢালা পোশাক পরা, প্রতিদিন গোসল করা এবং ঘামের পর দ্রুত জামা পরিবর্তন করা জরুরি। প্রয়োজনে অ্যান্টিসেপটিক পাউডার বা ক্রিম ব্যবহার করা যায়। ঘর পরিষ্কার ও ঠান্ডা রাখাও এই রোগ এড়াতে সাহায্য করে।
৪. ফুড পয়জনিং ও ডায়রিয়া: খাদ্যজনিত অসুখের ঝুঁকিঃ
তীব্র গরমে খাবার দ্রুত পচে যায় এবং এতে সহজেই ব্যাকটেরিয়া জন্মায়, যা ফুড পয়জনিংয়ের অন্যতম কারণ। রাস্তার খোলা খাবার, বাসি বা অনিয়মিতভাবে সংরক্ষিত খাবার থেকে সহজেই পেটের পীড়া, ডায়রিয়া ও বমি হতে পারে। গরমে পেটের অসুখ শিশুদের মাঝে বেশি দেখা দেয়। খাওয়ার আগে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, বিশুদ্ধ পানি পান করা, খাবার ঢেকে রাখা এবং বাইরের খাবার এড়িয়ে চলাই প্রধান প্রতিরোধ। ডায়রিয়া হলে ওআরএস, স্যালাইন এবং তরল খাবার খাওয়াতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া উচিত নয়। খাদ্যবিধিতে সচেতনতা এই সময়ে অত্যন্ত প্রয়োজন।
৫. তাপ-জনিত শ্বাসকষ্ট ও অ্যালার্জিঃ
গরমে বাতাসে ধুলাবালি ও অ্যালার্জেনের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা হাঁপানি ও অন্যান্য শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য মারাত্মক হতে পারে। তাপমাত্রা বাড়লে বাতাসের গুণমান কমে যায় এবং এতে ওজোন গ্যাসের ঘনত্ব বাড়ে, যা ফুসফুসের জন্য ক্ষতিকর। যাদের আগে থেকেই ব্রঙ্কাইটিস, COPD বা অ্যালার্জি আছে, তারা গরমে বেশি কষ্ট পান। এ সময় মাস্ক ব্যবহার, ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখা এবং ধুলাবালি থেকে নিজেকে রক্ষা করাই প্রধান করণীয়। প্রয়োজনে ইনহেলার ব্যবহার ও নিয়মিত ওষুধ খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। অতিরিক্ত গরমের দিনে খোলা জায়গায় ব্যায়াম বা দৌড়ানো এড়িয়ে চলা উচিত।
৬. মাথাব্যথা ও মাইগ্রেনের প্রকোপঃ
গরমে অনেকের মাথাব্যথা বা মাইগ্রেন বেড়ে যায়। বিশেষ করে সূর্যের আলোয় দীর্ঘ সময় থাকলে বা ডিহাইড্রেশনের কারণে মাথাব্যথা তীব্র হয়। যারা নিয়মিত মাইগ্রেনে ভোগেন, তাদের জন্য গরম একটি ট্রিগার হিসেবে কাজ করে। রোদে বের হওয়ার আগে সানগ্লাস ব্যবহার, টুপি পরা এবং পানি খাওয়ার অভ্যাস এ ক্ষেত্রে সহায়ক। প্রচণ্ড গরমে মাথাব্যথা শুরু হলে ঠান্ডা স্থানে বসে বিশ্রাম নিতে হবে এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অতিরিক্ত কফি বা চিনি গ্রহণ এ সময় এড়িয়ে চলা ভালো, কারণ এসব উপাদান মাইগ্রেন বাড়িয়ে দিতে পারে।
৭. ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনঃ
গরমে প্রস্রাবের পরিমাণ কমে গেলে এবং শরীরে পানির অভাব হলে ইউরিনারি ইনফেকশন বা প্রস্রাবজনিত সমস্যা বাড়ে। নারীদের মধ্যে এই রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়, তবে পুরুষরাও নিরাপদ নয়। ব্যাকটেরিয়া মূত্রথলিতে জমে গিয়ে ব্যথা, জ্বালাপোড়া এবং জ্বরের মতো উপসর্গ তৈরি করে। প্রতিকার হিসেবে পর্যাপ্ত পানি পান করা, প্রস্রাব চেপে না রাখা এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মেনে চলা গুরুত্বপূর্ণ। যারা দীর্ঘ সময় বাইরে থাকেন, তারা পর্যাপ্ত তরল পানীয় ও ওআরএস সঙ্গে রাখতে পারেন। গরমে ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়াটাই ভালো, কারণ এটি ইনফেকশন রোধে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
৮. শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য বিশেষ সতর্কতাঃ
তীব্র গরমে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকে শিশু ও বয়স্করা। শিশুদের শরীরে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কম এবং তারা সহজেই ডিহাইড্রেটেড হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, বয়স্কদের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় তারা দ্রুত হিট স্ট্রোক বা ঘর্মজনিত রোগে আক্রান্ত হন। এদের জন্য বিশেষ যত্ন নেওয়া জরুরি পর্যাপ্ত পানি খাওয়ানো, হালকা খাবার খাওয়ানো, খোলা জায়গায় কম রাখা এবং নিয়মিত বিশ্রাম নিশ্চিত করা উচিত। স্কুলগামী শিশুদের দুপুরের তীব্র রোদে বাইরে না পাঠানোই ভালো। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ বা স্যালাইন সরবরাহ রাখতে হবে। এদের ছোট অসুস্থতাকেও অবহেলা করা যাবে না।
তীব্র গরম কোনো সাধারণ সমস্যা নয় এটি জীবনের জন্য হুমকি হতে পারে যদি সচেতন না হওয়া হয়। গরমে শরীরের পরিবর্তনগুলো বুঝে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া গেলে অনেক জটিলতা এড়ানো সম্ভব। তাই এই গ্রীষ্মে নিজেকে ও আপনার পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে সাবধানতা অবলম্বন করুন, সচেতন থাকুন।