ঢাকা ০৩:৪৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম :
শহিদ আবু সাঈদ হত্যা মামলা: সাবেক ভিসি হাসিবুরসহ ২৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাকিস্তান টেস্ট দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পেলেন আজহার মাহমুদ স্থলবন্দরে রয়েছে নিরাপত্তায় ঘাটতি, আছে চোরাচালানের অভিযোগ: নৌপরিবহন উপদেষ্টা সাবেক এমপি সাবিনা আক্তার তুহিনের দুইদিনের রিমান্ড মঞ্জুর চলতি অর্থবছরে আদায় ৩ লাখ ৬০ হাজার ৯২২ কোটি টাকা: এনবিআর চেয়ারম্যান পিআর পদ্ধতির আড়ালে গভীর ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে: এ্যানি খুলনায় ট্রাকের ধাক্কায় ইজিবাইকের ২ যাত্রী নিহত, আহত ৪ অক্টোবরের মধ্যে ভাঙাচোড়া রাস্তা সংস্কার ও পুরোনো বাস সরানো হবে: পরিবেশ উপদেষ্টা মেক্সিকোর একটি শ্মশান থেকে স্তূপীকৃত ৩৮১ মরদেহ উদ্ধার ইতিহাসে প্রথম চীনে অনুষ্ঠিত হলো এআই-চালিত হিউম্যানয়েড রোবট ফুটবল ম্যাচ

বাগেরহাটে বিলুপ্তির পথে মৃৎশিল্প, টিকে থাকতে নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন শিল্পীরা

খবরের কথা ডেস্ক
  • আপডেট সময় ১০:২৩:৪৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৬ মে ২০২৫
  • / 60

ছবি সংগৃহীত

 

সময়ের সঙ্গে বদলে গেছে মানুষের জীবনধারা, রুচি ও প্রয়োজন। আধুনিকতা ও অর্থনৈতিক উন্নতির ছোঁয়ায় গ্রামবাংলার বহু ঐতিহ্য আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। এমনই এক বিলুপ্তপ্রায় শিল্প মৃৎশিল্প যা এক সময়ের জনপ্রিয়তা হারিয়ে প্লাস্টিক ও মেলামাইনের আধিপত্যে কোণঠাসা।

বাগেরহাট সদর উপজেলার তালেশ্বর ইউনিয়নের গাবরখালী গ্রামের কুমারপাড়ায় গেলে দেখা যায়, এখনও কিছু পরিবার বংশপরম্পরায় এই শিল্প ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। এক সময় কাঠের তৈরি চাকা থাকলেও এখন লোহার চাকায় ঘোরে কুমোরদের জীবনের চাকা। চাকার ওপর শিল্পীর দক্ষ হাতে তৈরি হচ্ছে মাটির হাঁড়ি, পাতিল, খেলনা, ফুলদানি ও নানা সৌখিন সামগ্রী।

প্রবীণ মৃৎশিল্পী রবিন পাল বলেন, “এই কাজে নির্দিষ্ট ধরনের মাটি লাগে, যা এখন বরিশাল থেকে আনতে হয়। আগে কাছের নদীর চর থেকেই পাওয়া যেত, কিন্তু এখনকার মাটি দূষিত। আধুনিক কোনো যন্ত্রপাতিও নেই, এখনও সনাতন পদ্ধতিতেই কাজ করতে হয়।”
তিনি জানান, “মাসে ১৫-১৬ হাজার টাকা খরচ করলেও লাভ থাকে মাত্র ৮ হাজার। দোকানদাররা আমাদের তৈরি জিনিস ১০ টাকায় কিনে ২০-৩০ টাকায় বিক্রি করেন। প্রকৃত শিল্পীরা বঞ্চিত হচ্ছেন।”

একসময় এই পেশায় ২০০টিরও বেশি পরিবার জড়িত থাকলেও এখন টিকে আছে মাত্র ১৫টি পরিবার। জীবিকার তাগিদে অনেকেই পেশা বদলে নিয়েছেন।
বিএ পাস করা শিল্পী খগেন পাল বলেন, “চাকরির পেছনে না ছুটে মৃৎশিল্পকেই বেছে নিয়েছিলাম। এক সময় আমাদের পণ্য দেশের নানা জায়গায় নৌকায় করে যেত। এখন নিজের গ্রামেই চাহিদা নেই।”
তিনি মনে করেন, বিদ্যুৎচালিত চাকা থাকলে কাজ সহজ হতো, নতুন প্রজন্মের আগ্রহও বাড়ত।

মৃৎশিল্পী দীপালী রানী পাল বলেন, “মাটির হাঁড়ির পানি ঠান্ডা থাকে, রান্নার স্বাদ আলাদা হয়। কিন্তু মানুষ এখন মেলামাইন ও প্লাস্টিকে অভ্যস্ত। এতে শুধু আমাদের পেশা নয়, মানুষের স্বাস্থ্যও ঝুঁকিতে পড়ছে।”
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “লাভ নেই বলে কেউ আর শিখতে চায় না। ১০-১৫ বছর পর হয়তো গ্রামেই আর কোনো মৃৎশিল্পী থাকবে না।”

তালেশ্বরের শেখর চন্দ্র পাল বলেন, “মেলায় গিয়ে পণ্য বিক্রি করি। ফুলদানি বা চায়ের কাপের মতো সৌখিন জিনিসে কিছুটা চাহিদা আছে, কিন্তু প্রচারের অভাবে বিক্রি হয় না। আমি ৩০ বছর ধরে এই পেশায়, কিন্তু ছেলেকে অন্য পেশায় দিতে চাই।”

তালেশ্বরের কমলা পাল জানান, “সরস্বতী ও দুর্গাপূজার সময় প্রতিমার অর্ডার বাড়ে, তখন ব্যস্ততা থাকে। বছরের বাকি সময় কাজ থাকে না, তাই অনেকে অন্য পেশা বেছে নিচ্ছেন।”
একসময় এই পেশায় জড়িত থাকা উজ্জ্বল পাল বলেন, “বেচাবিক্রি নেই বলে এখন অন্যের জমিতে কাজ করি।”

স্থানীয় শিক্ষক দীপক কুমার পাল বলেন, “মাটির পণ্য আমাদের সংস্কৃতির অংশ ছিল। এটি পরিবেশবান্ধব হলেও হারিয়ে যাচ্ছে। প্রশিক্ষণ, যন্ত্রপাতি, সহজ শর্তে ঋণ ও বাজারজাতকরণ নিশ্চিত করতে হবে।”

বাগেরহাট বিসিক কর্মকর্তা মো. শরীফ সরদার বলেন, “আমরা চাইলে তালেশ্বরের মৃৎশিল্পীদের প্রশিক্ষণ, ঋণ ও মার্কেটিং সহযোগিতা দিতে পারি। তাদের পাশে থাকতে বিসিক প্রস্তুত।”

এই শিল্প টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, আধুনিকীকরণ এবং নতুন প্রজন্মের আগ্রহ বাড়ানোর উদ্যোগ। না হলে গ্রামবাংলার মাটি গড়া এই ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে চিরতরে।

নিউজটি শেয়ার করুন

বাগেরহাটে বিলুপ্তির পথে মৃৎশিল্প, টিকে থাকতে নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন শিল্পীরা

আপডেট সময় ১০:২৩:৪৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৬ মে ২০২৫

 

সময়ের সঙ্গে বদলে গেছে মানুষের জীবনধারা, রুচি ও প্রয়োজন। আধুনিকতা ও অর্থনৈতিক উন্নতির ছোঁয়ায় গ্রামবাংলার বহু ঐতিহ্য আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। এমনই এক বিলুপ্তপ্রায় শিল্প মৃৎশিল্প যা এক সময়ের জনপ্রিয়তা হারিয়ে প্লাস্টিক ও মেলামাইনের আধিপত্যে কোণঠাসা।

বাগেরহাট সদর উপজেলার তালেশ্বর ইউনিয়নের গাবরখালী গ্রামের কুমারপাড়ায় গেলে দেখা যায়, এখনও কিছু পরিবার বংশপরম্পরায় এই শিল্প ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। এক সময় কাঠের তৈরি চাকা থাকলেও এখন লোহার চাকায় ঘোরে কুমোরদের জীবনের চাকা। চাকার ওপর শিল্পীর দক্ষ হাতে তৈরি হচ্ছে মাটির হাঁড়ি, পাতিল, খেলনা, ফুলদানি ও নানা সৌখিন সামগ্রী।

প্রবীণ মৃৎশিল্পী রবিন পাল বলেন, “এই কাজে নির্দিষ্ট ধরনের মাটি লাগে, যা এখন বরিশাল থেকে আনতে হয়। আগে কাছের নদীর চর থেকেই পাওয়া যেত, কিন্তু এখনকার মাটি দূষিত। আধুনিক কোনো যন্ত্রপাতিও নেই, এখনও সনাতন পদ্ধতিতেই কাজ করতে হয়।”
তিনি জানান, “মাসে ১৫-১৬ হাজার টাকা খরচ করলেও লাভ থাকে মাত্র ৮ হাজার। দোকানদাররা আমাদের তৈরি জিনিস ১০ টাকায় কিনে ২০-৩০ টাকায় বিক্রি করেন। প্রকৃত শিল্পীরা বঞ্চিত হচ্ছেন।”

একসময় এই পেশায় ২০০টিরও বেশি পরিবার জড়িত থাকলেও এখন টিকে আছে মাত্র ১৫টি পরিবার। জীবিকার তাগিদে অনেকেই পেশা বদলে নিয়েছেন।
বিএ পাস করা শিল্পী খগেন পাল বলেন, “চাকরির পেছনে না ছুটে মৃৎশিল্পকেই বেছে নিয়েছিলাম। এক সময় আমাদের পণ্য দেশের নানা জায়গায় নৌকায় করে যেত। এখন নিজের গ্রামেই চাহিদা নেই।”
তিনি মনে করেন, বিদ্যুৎচালিত চাকা থাকলে কাজ সহজ হতো, নতুন প্রজন্মের আগ্রহও বাড়ত।

মৃৎশিল্পী দীপালী রানী পাল বলেন, “মাটির হাঁড়ির পানি ঠান্ডা থাকে, রান্নার স্বাদ আলাদা হয়। কিন্তু মানুষ এখন মেলামাইন ও প্লাস্টিকে অভ্যস্ত। এতে শুধু আমাদের পেশা নয়, মানুষের স্বাস্থ্যও ঝুঁকিতে পড়ছে।”
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “লাভ নেই বলে কেউ আর শিখতে চায় না। ১০-১৫ বছর পর হয়তো গ্রামেই আর কোনো মৃৎশিল্পী থাকবে না।”

তালেশ্বরের শেখর চন্দ্র পাল বলেন, “মেলায় গিয়ে পণ্য বিক্রি করি। ফুলদানি বা চায়ের কাপের মতো সৌখিন জিনিসে কিছুটা চাহিদা আছে, কিন্তু প্রচারের অভাবে বিক্রি হয় না। আমি ৩০ বছর ধরে এই পেশায়, কিন্তু ছেলেকে অন্য পেশায় দিতে চাই।”

তালেশ্বরের কমলা পাল জানান, “সরস্বতী ও দুর্গাপূজার সময় প্রতিমার অর্ডার বাড়ে, তখন ব্যস্ততা থাকে। বছরের বাকি সময় কাজ থাকে না, তাই অনেকে অন্য পেশা বেছে নিচ্ছেন।”
একসময় এই পেশায় জড়িত থাকা উজ্জ্বল পাল বলেন, “বেচাবিক্রি নেই বলে এখন অন্যের জমিতে কাজ করি।”

স্থানীয় শিক্ষক দীপক কুমার পাল বলেন, “মাটির পণ্য আমাদের সংস্কৃতির অংশ ছিল। এটি পরিবেশবান্ধব হলেও হারিয়ে যাচ্ছে। প্রশিক্ষণ, যন্ত্রপাতি, সহজ শর্তে ঋণ ও বাজারজাতকরণ নিশ্চিত করতে হবে।”

বাগেরহাট বিসিক কর্মকর্তা মো. শরীফ সরদার বলেন, “আমরা চাইলে তালেশ্বরের মৃৎশিল্পীদের প্রশিক্ষণ, ঋণ ও মার্কেটিং সহযোগিতা দিতে পারি। তাদের পাশে থাকতে বিসিক প্রস্তুত।”

এই শিল্প টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, আধুনিকীকরণ এবং নতুন প্রজন্মের আগ্রহ বাড়ানোর উদ্যোগ। না হলে গ্রামবাংলার মাটি গড়া এই ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে চিরতরে।