দাবানল: এক ভয়াবহ বিপদ
দাবানল (Wildfire) হলো একটি অগ্নিকাণ্ড যা দ্রুত বিস্তৃত হয় এবং প্রাকৃতিক বনভূমি, তৃণভূমি এবং শুকনো এলাকাগুলিতে ঘটে। এটি বনাঞ্চলে সংঘটিত একটি অনিয়ন্ত্রিত আগুন। প্রচণ্ড দাবদাহের কারণে অধিক ঘনত্বের বনে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। দাবানলকে বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের চেয়েও ভয়াবহ দুর্যোগ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কেননা বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস দেওয়া যায় এবং সচেতন থাকলে দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা যায়।কিন্তু দাবানলের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয় না।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে ছড়ানো দাবানল নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি তিন দিনেও, উল্টো ঝড়ের বেগে বাতাসে তা ছড়িয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকায়। শত শত ঘরবাড়ি পুড়েছে, প্রাণ গেছে অন্তত পাঁচজনের। ভয়াবহ এই দুর্যোগ মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে লস অ্যাঞ্জেলেস, প্রতিবেশী কাউন্টিগুলো থেকেও আনা হচ্ছে আগুন নেভানোর সরঞ্জাম ও কর্মী বাহিনী। যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরটিতে কেন দাবানল এমন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, সেই প্রশ্নটি এখন সামনে আসছে। দেশটির কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘ সময় বৃষ্টি না হওয়ায় ফলে খরা আর প্রবল বাতাসের কারণে দাবানল দ্রুত ছড়াচ্ছে।
গবেষকদের মতে, দাবানলের শুরুটা শুষ্ক বনভূমি বা ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ এলাকা থেকেই বেশি হয়। যখন কোনো আগুনের উৎস প্রচণ্ড তাপমাত্রায় এবং যথেষ্ট পরিমাণে অক্সিজেনের উপস্থিতিতে দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে আসে, তখন দাবানলের সূত্রপাত ঘটে। সাধারণত শুষ্ক বনভূমির ওপর বজ্রপাত হলে, বাতাসে পাশাপাশি থাকা মরা গাছের ঘর্ষণে, আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত লাভা বা বিভিন্ন পদার্থের জ্বলন্ত টুকরা থেকে সৃষ্টি হয় আগুনের ফুলকি। আগুনের এই ফুলকি ক্রমেই ওপরের দিকে উঠতে থাকে আর পোড়াতে থাকে বন। দাবানল প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট উভয় কারণেই হতে পারে। দাবানল প্রতিরোধ এবং এর ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য সচেতনতা ও আগাম প্রস্তুতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য দাবানল সৃষ্টির কারণগুলো প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়- প্রাকৃতিক কারণ ও মানবসৃষ্ট কারণ। প্রাকৃতিক কারণে দাবানলের সৃষ্টি হতে পারে বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদানের প্রভাবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হলো:
বজ্রপাত: বজ্রপাতের কারণে গাছ বা মাটি শুকিয়ে আগুন ধরে যেতে পারে।
খরার সময়: দীর্ঘ সময় বৃষ্টিহীন আবহাওয়ায় বনভূমি এবং তৃণভূমি খুবই শুকিয়ে যায়, যা অগ্নিসংযোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
তাপমাত্রা বৃদ্ধি: উষ্ণ এবং শুষ্ক আবহাওয়া দাবানলের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
ঘর্ষণ ও সূর্যের তাপ: শুকনো পাতা এবং গাছের ডালপালার মধ্যে ঘর্ষণ বা তীব্র সূর্যের তাপে আগুন ধরতে পারে।
মানুষের কর্মকাণ্ড দাবানলের প্রধান কারণগুলোর একটি। এর মধ্যে রয়েছে:
সিগারেট বা ম্যাচের অবশিষ্টাংশ: অসতর্কভাবে ফেলা জ্বলন্ত সিগারেটের অংশ বনভূমিতে দাবানল সৃষ্টি করতে পারে।
অবৈধ অগ্নিসংযোগ: জমি পরিষ্কার বা কৃষিকাজের জন্য অযথা আগুন লাগানো।
বনাঞ্চলে শিবিরে আগুন: ক্যাম্প ফায়ারের পর আগুন পুরোপুরি নিভিয়ে না রাখা।
শিল্পকর্ম ও নির্মাণকাজ: বিদ্যুৎ লাইনের স্পার্ক বা যন্ত্রপাতির ব্যবহারের সময় উৎপন্ন তাপ।
দাবানল দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে কিছু বিশেষ কারণের জন্য, যেমন: শুকনো গাছপালা এবং পাতা, তীব্র বাতাসের গতি, শুষ্ক মাটি এবং নিম্ন আর্দ্রতা। দাবানলের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ, বনজ সম্পদ এবং জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এটি মানুষ, প্রাণী এবং পরিবেশের জন্যও মারাত্মক হুমকি। সাম্প্রতিককালে মানবসৃষ্ট কারণেই দাবানল বেশি ঘটে থাকে। ধারণা করা হয়, বর্তমানে শতকরা ৮৪ ভাগ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন মানবসৃষ্ট কারণে দাবানল সংঘটিত হয়েছে।
বাংলাদেশে সাধারণত দাবানলের ঘটনা কমই ঘটে। যা ঘটে তাকে ঠিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলা যায় না। দুর্ঘটনা বা মানুষের অসাবধানতাই এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ী। আমেরিকা, ক্যালিফোর্নিয়া, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকাসহ বিশ্বের অনেক দেশেই দাবানলের ঘটনা ঘটে। এর ফলে বৃক্ষসম্পদ নষ্ট হয়। নষ্ট হয় জীববৈচিত্র্য। দাবানলের আগুন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। বিগত এক দশকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বড় পরিসরে অনেকগুলো দাবানলের ঘটনা ঘটে গেছে। এর মধ্যে গত দশকের মধ্যভাগ থেকে শুরু হয়ে শেষভাগ পর্যন্ত চলা ক্যালিফোর্নিয়ার দাবানলের ঘটনাটি স্মরণকালের অন্যতম ভয়াবহ দুর্যোগ এবং ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দাবানল। সে বছর ক্যালিফোর্নিয়ায় বিচ্ছিন্নভাবে প্রায় সাড়ে আট হাজারেরও বেশি দাবানলের ঘটনা ঘটেছে এবং শেষ পর্যন্ত সেগুলো বিভিন্ন স্থানে মিলিত হয়ে বড় আকার ধারণ করেছে। ফলে প্রায় পুরো বছরই মার্কিন সরকারকে এই দুর্যোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে।
মো. মোশারফ হোসাইন
উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট, সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া