বিলুপ্তির পথে মহেশপুরের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প, টিকে থাকার সংগ্রামে কুমারপাড়া

- আপডেট সময় ০৭:৪৪:২৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫
- / 33
জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার মহেশপুর গ্রামে একসময়ের গৌরবময় মৃৎশিল্প আজ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প বংশপরম্পরায় কুমারদের হাতে গড়ে উঠলেও, আধুনিকতার ছোঁয়ায় এবং সময়ের পরিবর্তনে তার জৌলুস হারাতে বসেছে। এখন আর আগের মতো কুমারপাড়ার মানুষ মাটির তৈরি জিনিসপত্র বানিয়ে দিন কাটান না। অথচ সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও মাটির তৈজসপত্রের চাহিদা ছিল সর্বত্র।
বাঙালির জীবনের নানা ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবে মাটির পণ্যের ব্যবহার ছিল অবিচ্ছেদ্য। গায়ে হলুদ, সুন্নতে খতনা, বিবাহ, জন্মদিন, অন্নপ্রাশন, নবান্ন কিংবা পহেলা বৈশাখ—এসব আয়োজনে মাটির সামগ্রীর বিশেষ কদর ছিল। কিন্তু বর্তমানে প্লাস্টিক, ম্যালামাইন, কাচ, ধাতব ও সিরামিকের সহজলভ্যতায় মাটির তৈরি সামগ্রীর গুরুত্ব অনেকটাই কমে গেছে। তার ওপর ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের প্রতি সরকারি নজরের অভাবে মহেশপুরের মৃৎশিল্প ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।
মহেশপুর গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, একসময় যে কুমারপাড়া ছিল শিল্পের প্রাণ, সেখানে আজ হাতে গোনা কয়েকজন শিল্পীই এই পেশায় টিকে আছেন। বাকি অনেকেই বাধ্য হয়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। কারণ আগের মতো আর চাহিদা নেই, আয়ও নেই। ভবিষ্যতের নিরাপত্তাহীনতায় অনেকেই সন্তানদের মৃৎশিল্পে আগ্রহী করতে চান না। তারা সন্তানদের শিক্ষিত করে চাকরির দিকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করছেন।
তবুও কুমারপাড়ার প্রায় ৪০টি পরিবার আজও পূর্বপুরুষের পেশাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। কিন্তু জীবনের বাস্তবতা তাদের প্রতিদিনই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করছে।
প্রবীণ মৃৎশিল্পী সুনীল চন্দ্র পাল বলেন, “ছোটবেলা থেকে বাবার সঙ্গে মাটির জিনিস বানাতাম। আগে এসবের খুব কদর ছিল। এখন আর সেই দিন নেই।” তিনি আরও বলেন, “মাটির কাজ করতে খরচ বেশি পড়ে। সরকার যদি মাসিক ভাতা বা সহজ ঋণের সুযোগ দিত, তাহলে হয়তো আমরা বাঁচতে পারতাম।”
গুরুচরণ পাল বলেন, “বাপ-দাদার পেশা টিকিয়ে রাখতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। সব কিছুর দাম বেড়েছে। সরকারি সহায়তা ছাড়া টিকে থাকা সম্ভব না।”
নীরেন চন্দ্র পাল জানান, “আগে নিজের পুকুরের মাটি দিয়ে কাজ করতাম, এখন বাইরে থেকে মাটি-বালু কিনে আনতে হয়। রঙের দামও অনেক।”
কালাই উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা শামিমা আক্তার জাহান বলেন, “মৃৎশিল্প আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ। আমরা প্রশিক্ষণ, মেলা ও প্রদর্শনীর মাধ্যমে শিল্পীদের পাশে থাকবো এবং এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখবো।”
মহেশপুরের মৃৎশিল্প কেবল একটি পেশা নয়, এটি একটি জীবন্ত ইতিহাস। সরকারি সময়োপযোগী সহায়তা ও আধুনিক বিপণন ব্যবস্থা ছাড়া এই ঐতিহ্য ধরে রাখা কঠিন। হারিয়ে গেলে, তা হবে আমাদের সাংস্কৃতিক ভান্ডারের এক অপূরণীয় ক্ষতি।