পানামা খাল: আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের সংযোগকারী জলপথ
পানামা খালের নামটা সামনে আসলেই মনে হয় মানুষের তৈরী এক আশ্চর্য ও অবাক বিস্ময়েরর নাম। মানুষের ইঞ্জিনিয়ারিং দক্ষতার এক আশ্চর্য নিদর্শন এই পানাম খাল। এই খাল জাহাজ চলাচলের জন্য পানামা প্রজাতন্ত্রের ইস্থমাসে নির্মীত একটি খাল যা আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরকে যুক্ত করেছে। ইস্থমাস বলতে দুটো বড় ভূখণ্ডকে সংযোগকারী সরু ভূমিকে বোঝায় যার অন্য দুই পাশে সাধারণত পানি থাকে। পানামার ইস্থমাস ভূখণ্ড আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরকে আলাদা করে রাখে এবং উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশকে যুক্ত রাখে। কিন্তু ইস্থমাস ভূখণ্ডে খননকৃত পানামা খাল এক অর্থে মহাদেশ দুটিকে আলাদা করে মহাসাগর দুটিকে যুক্ত করেছে।
১৯৯৯ সাল থেকে খালটির মালিক ও পরিচালক হচ্ছে পানামা প্রজাতন্ত্র। উল্লেখ্য প্রায় ষোড়শ শতাব্দী থেকে মানুষ এই খাল তৈরি করার স্বপ্ন দেখেছিল। সেই সময় আমেরিকার পূর্ব উপকূল থেকে পশ্চিম উপকূল পর্যন্ত যাওয়ার জন্য দক্ষিণ আমেরিকার কেপ হর্ন থেকে ঘুরে যেতে হতো। আর এর জন্য পথ অতিক্রম করতে হতো ১৫ হাজার কিলোমিটার। সেই সময়ের জাহাজগুলোর এই পথ অতিক্রম করতে প্রায় দুই মাস সময় লেগে যেতো। তখন থেকেই মানুষ ভাবতে থাকে যদি ইস্থমাস ভূখণ্ডে খাল তৈরি করা যায় তাহলে ১৫ হাজার কিলোমিটারের ভ্রমন মাত্র ৮২ কিলোমিটারের মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব। এছাড়া নতুন এই নৌপথ দিয়ে যে টাকা ইনকাম করা যাবে সেটা একটা সোনার খনি থেকে কম না। আরেকটা উল্লেখযোগ্য তথ্য হলো তৎকালে আমেরিকায় যেসব দেশ কলোনি স্থাপন করেছিল, তাদের কেউ কেউ চেয়েছিল এমন একটি জলপথ তৈরি করতে, যা আটলান্টিক মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে জাহাজ চলাচলের সময় কমিয়ে আনবে। তবে তাদের ওই চাওয়া কখনোই পূরণ হয়নি। এরপর বিশ শতকের প্রথম দিকে প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট পানামার উপর দিয়ে একটি জলপথ তৈরি করাকে অগ্রাধিকার হিসেবে গ্রহণ করেন। বর্তমান পানামা ভূখণ্ডে তখন কলম্বিয়ার অংশ ছিলো অর্থাৎ তখন পানামা নিয়ন্ত্রণ করত রিপাবলিক অব কলম্বিয়া। কিন্তু মার্কিন সমর্থিত এক বিদ্রোহে পানামা ও কলম্বিয়া ভাগ হয়ে যায়, ১৯০৩ সালে আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন দেশ পানামা প্রজাতন্ত্র। সদ্য স্বাধীন দেশ পানামা ও যুক্তরাষ্ট্র ওই বছরই একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে, যার আওতায় ১০ মাইল লম্বা একটি ভূখণ্ড মার্কিন নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এর বিনিময়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পদ হস্তগত হয় পানামার। আর যুক্তরাষ্ট্র পায় একটি খাল খননের অধিকার।
ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, স্প্যানিশ অভিযাত্রী ভাস্কো নুয়েঞ্জ ডি বালবোয়াই প্রথম ইউরোপীয়, যিনি আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে খাল খনন করে এই সংযোগের কথা বলেছিলেন। সে সময়ের স্প্যানিশ রাজা বালবোয়াইয়ের এ ধারণাকে উড়িয়ে দেন। তবে ১৫৩৪ সালে অপর রাজা চার্লস পঞ্চম প্রস্তাবটি যাচাইয়ে একটি কমিটি গঠন করেন। কমিটি তদন্ত করে জানায় একটি জাহাজ প্রবেশ করতে পারে এমন খাল ওই স্থানে খনন করা অসম্ভব। এরপর সময় কেটে যায় শতাব্দীর পর শতাব্দী। পানামা খাল আর খনন করা যায়নি। আঠারো শতকের শেষের দিকে এ পথটিতে ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের চোখ পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথমে খালটি নিকারাগুয়া দিয়ে করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু নিকারাগুয়ার রাজনৈতিক অসন্তোষ ও ফরাসি প্রকৌশলী ফিলিপ বোনাও ভারিল্লার চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র এ খাল পানামা দিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথমে দুই মহাসাগরকে এভাবে এক করাটা একেবারেই অসম্ভব ছিল। এর মূল কারণ পানির উচ্চতার তারতম্য। খালটি দুই সমুদ্র সমতল হতে ৮৫ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। ঠিক এ কারণেই পনেরো শতকে পানামা খাল তৈরি করা সম্ভব হয়নি।
উল্লেখ্য ১৮৬৯ সালে সুয়েজ খাল প্রকল্পে ফরাসিদের সাফল্যের পর যুক্তরাষ্ট্র উত্তর আমেরিকার সাথে ইউরোপ, এশিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকার দূরত্ব কমাতে বিকল্প একটি জলপথ তৈরির চিন্তা করতে থাকে। ১৮৮১ সালে খালটি খনন শুরু করে ফ্রান্স। প্রকৌশলগত ত্রুটির কারণে আবারও ব্যর্থ হয় খনন কাজ। এরপর যুক্তরাষ্ট্র সরকার এটি নিয়ে কলম্বিয়া সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়া করার চেষ্টা চালায়। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক ও সামরিক নৌজাহাজগুলো সহজে আটলান্টিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে নেয়ার জন্য খাল খননের প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে কলম্বিয়া সরকার। আর এ প্রত্যাখ্যানের পরই মূলত যুক্তরাষ্ট্রের কুটনৈতিক চালে একটি অভ্যুত্থান ঘটে। এভাবে ১৯০৩ সালে জন্ম হয় পানামা নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের। এরপর খাল খননে আর বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হয়নি যুক্তরাষ্ট্রের।
পানামা-যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকার ১৯০৪ সালে খালটি পুনরায় খনন শুরু করে। শুরুর দিকে বেশ কয়েকটি পরীক্ষা ব্যর্থ হয়। ভারি বর্ষণ, আর্দ্রতা ও স্থানীয় বিভিন্ন রোগ ছিল খাল খননের অন্যতম প্রতিবন্ধক। এর আগেও স্পেন খাল খনন শুরু করলে নানা কারণে বিশ হাজার শ্রমিক দুর্ঘটনা ও মশার কামড়ে হলুদ জ্বর হয়ে মারা গেলে খনন বন্ধ রাখা হয়। যুক্তরাষ্ট্র তার কারিগরি সক্ষমতা দিয়ে শ্রমিক মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনে। তারপরেও হাজার হাজার শ্রমিক মারা যায়। ১৯০৪ থেকে একটু পেছনে ফিরলে অর্থাৎ ১৯০৩ সালে, নির্মাণাধীন পানামা খালে বৃষ্টিস্নাত একদিন। সেখানে এমন ভেজা পাথুরে পাহাড়ে কাজ করতে গিয়ে একজন শ্রমিক হঠাৎ পা পিছলে মৃত্যুদুয়ারে হাজির হয়। ঠিক তখন থেকে শুরু করে ১৯১৪ পর্যন্ত দুর্ঘটনা, ম্যালেরিয়া, পীত জ্বরে মারা যায় আরো ৫,৬০০ জন। সরকারি খাতায় থাকা এই ৫,৬০০ জনের অংকটা বাস্তবে হয়তো আরো বড় (ধারণা অনুসারে প্রায় ২২ হাজর)। ৮০ কিলোমিটার লম্বা প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্যে সংযোগকারী এই কৃত্রিম জলপথটি বাস্তবেই যেন এক বিস্ময়।
পানামা খাল তৈরির আগে ইউরোপ থেকে উত্তর আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে অথবা এশিয়া থেকে উত্তর আমেরিকার দক্ষিণে পৌঁছাতে পুরো দক্ষিণ আমেরিকার উপকূল সংলগ্ন এলাকা পাড়ি দিতে হতো। যাতে গন্তব্যে পৌঁছাতে লেগে যেত অতিরিক্ত ১৪ দিন এবং পাড়ি দিতে হতো আরও প্রায় পনেরো হাজার কিলোমিটার জলপথ। এভাবে ১৯০৩ সালে শুরু হওয়া খাল খননের কাজ শেষ হয় ১৯১৪ সালে। প্রকৌশল ও প্রযুক্তি সুপারপাওয়ার হিসেবে তখন যুক্তরাষ্ট্র সবার কাছ থেকে বাহবা পায়। কিন্তু এই খাল খননের জন্য বড় ধরনের মানবিক মূল্য দিতে হয়েছিল। যেখানে শ্রমিকদের ফেস করতে হয়েছিল বিষাক্ত মশা এবং মাকড়সাদের এবং হাজার হাজার মানুষের বলিদানের পর তবেই এই খাল তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল। এভাবে তৈরি হয় সভ্যতার অনন্য মাপকাঠি পানামা যোজক।
অনেকেই প্রশ্ন করতে পারে এই খাল শুধু পানামা দিয়ে কেন আশেপাশের আর কোনো দেশ ছিলো না। উত্তর হলো ছিলো এবং এটা হলো পানামার পার্শ্ববর্তী দেশ নিকারাগুয়া। দুটি দেশই প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগরে চলাচলকারী জাহাজের এই অতিরিক্ত দূরত্ব কমিয়ে দিতে পারত। কিন্তু নিকারাগুয়ায় অসংখ্য সক্রিয় আগ্নেয়গিরির প্রভাব এবং পানামায় সেসময় চলাকালীন ফরাসিদের খাল খননের ব্যর্থ প্রচেষ্টা আমেরিকার প্রকৌশলীদের পানামাতেই কাজটি সম্পন্ন করার পেছনে প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ১৯০৩ সালে তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট প্রায় ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে ফরাসিদের থেকে নির্মাণাধীন খাল খনন প্রকল্পটি কিনে নেন। এরই মাধ্যমে শুরু হয় এক যুগেরও বেশি সময়ব্যাপী পানামা খালের খনন কাজ। পানামা খাল প্রকল্পের শুরুতে আমেরিকা কলাম্বিয়ার সাথে Hay- Herran চুক্তি স্বাক্ষর করতে চান, যার মাধ্যমে পানামা খাল ও সংলগ্ন এলাকায় আমেরিকার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু সেসময় পানামাও কলাম্বিয়া থেকে স্বাধীনতা অর্জনের চেষ্টায় ছিল। তখনই আমেরিকার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পানামা রক্তপাতহীনভাবে কলাম্বিয়ার থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এবং বিনিময়ে আমেরিকানদের পানামা খালে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে Torrjios- Carter চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ১৯৯৯ সালে আমেরিকা খালটির দায়িত্ব পানামাকে ফিরিয়ে দেয়। সেই থেকে এই খালের একচ্ছত্র মালিক পানামা।
পানামার ইতিহাসের সাথে সুয়েজ খালের একটা সম্পর্ক রয়েছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আঠারো শতকে লোহিত সাগরের সৈয়দ বন্দর থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত এশিয়া ও ইউরোপের সংযোগকারী সুয়েজ খাল তৈরি করেছিল যে ফরাসিরা, তারাই কিন্তু পানামা খাল তৈরির প্রকল্প আমেরিকানদের আগে শুরু করে। কিন্তু পানামার বন্ধুর ভূমি ও সমতল মিশর ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যে একে অপরের থেকে পুরোপুরি আলাদা। এ কারণেই সুয়েজ খালের আদলে পানামা খালের নকশা করাটাই ছিল ফরাসি প্রকৌশলীদের একটি বড় ভুল। ফরাসিদের থেকে দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই আমেরিকানরা বুঝতে পারে, পানামার এই পাহাড়ি প্রকৃতিতে খাল তৈরির প্রক্রিয়াটি হবে খুব জটিল ও চ্যালেঞ্জিং। তাই সেসময় বিশ্বজুড়ে উদীয়মান আমেরিকান আধিপত্যের কাছে বন্ধুর এই প্রকৃতিতে সফলভাবে জলপথটি তৈরি করা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবের।
ধারণা করা হয়, পানামা খাল তৈরির জন্য আমেরিকান প্রশাসন শুরুতে যে বাজেট করেছিল তার চেয়ে প্রায় ৪৪৪ শতাংশ বেশি অর্থ বরাদ্দ করতে হয় কাজটি সফলভাবে শেষ করতে। উল্লেখ্য পানামা খালটির ভৌগলিক নকশা অনুযায়ী পার্বত্য অঞ্চলে এর অবস্থান হওয়ার কথা। ফলে পাহাড় কেটে যদি খালটি তৈরি করা হত তবে খালের পানির উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতার সমান হওয়া জরুরি ছিল। কারণ উঁচু জায়গা থেকে পানি সবসময়ই নিচু জায়গার দিকে প্রবাহিত হয়। তাই খালের অবস্থান উঁচুতে হলে তাতে পানিও থাকবে না আর জাহাজও চলতে পারবে না। সে কারণেই ফরাসিরা পাহাড়গুলো একবারে কেটে সমতল ভূমি তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এ ধরনের নকশায় পারিপার্শ্বিক ভূপ্রকৃতি ও বৃষ্টি প্রধান এলাকা হওয়ায় খালটি সমুদ্রের সাথে এক সমতলে যদি তৈরি হতো তবে পাহাড় থেকে আশেপাশের মাটি ধ্বসে খালটি ভরাট হয়ে যেত। সেক্ষেত্রে পুনরায় খালটি আবার খনন করতে হতো। নির্মাণকাজ শুরুর অল্প কয়েক বছর পরে নকশার এত বড় ত্রুটি দেখেই তারা মূলত প্রকল্পটি আমেরিকানদের কাছে বিক্রি করে দেয়। কিন্তু আমেরিকা পাহাড় কেটে সমতল ভূমির তৈরির পরিবর্তে জাহাজকে কীভাবে পাহাড়ে তোলা যায় তার ব্যবস্থা করে, যার জন্য নির্মাণ করতে হয় আরো একটি বড় প্রকল্প- গাতুন হ্রদ, যা এক সময় ছিল পৃথিবীর বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ। আমেরিকার এই নতুন নকশা অনুযায়ী, পানামা খালে জাহাজগুলো প্রবেশ করে প্রথমেই কতগুলো কৃত্রিমভাবে বদ্ধ জলাশয়ে, যেগুলোকে বলা হয় ‘লক’। এর মাধ্যমে জাহাজগুলোকে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৬ মিটার উঁচুতে গাতুন হ্রদ পর্যন্ত তোলা হবে এবং এই হ্রদ পাড়ি দিয়ে পুনরায় কিছু লক অতিক্রম করে জাহাজগুলো সাগরে নেমে যাবে।
বর্তমানে আটলান্টিক থেকে কোনো জাহাজ পানামা খালের দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করতে চাইলে প্রথমে তাকে তিনটি লক পাড়ি দিতে হবে। এই লকগুলোর দুপাশে দুটি দরজা থাকে এবং মেঝেতে পাশের উঁচু লক থেকে নিচু লকটির দিকে নিয়ন্ত্রিতভাবে পানি প্রবাহিত করার ব্যবস্থা থাকে। একটি জাহাজ প্রথম লকের সমুদ্রের দিকে এসে পৌঁছালে দ্বিতীয় লক থেকে পানি প্রথম লকে ভরা হয়, যাতে প্রথম লকের পানি এবং সমুদ্রের পানির উচ্চতা সমান হয়। তখন সমুদ্রের দিকের দরজাটি খুলে দিলে জাহাজ প্রথম লকে ঢুকে যায় এবার দ্বিতীয় লকটি থেকে আরো পানি প্রথম লকে ঢোকানো হয়, যাতে প্রথম ও দ্বিতীয় লকের পানি সমান উচ্চতায় থাকে এবং জাহাজ দ্বিতীয় লকের উচ্চতা পর্যন্ত ভেসে ওঠে। তখন দ্বিতীয় লকের দরজাটি খুলে দিলে জাহাজ এতে ঢুকে যায়। এভাবেই জাহাজটি পৌঁছে যায় ২৬ মিটার উচ্চতার গাতুন হ্রদে। তৈরির সময় প্রতিটি লকের দুটো দরজার মধ্যে দূরত্ব ছিল প্রায় ৩২০ মিটার এবং প্রস্থে লকগুলো প্রায় ৩৩.৫৩ মিটার। লকগুলো প্রায় ২৬.৭ মিলিয়ন গ্যালন পানি ধারণ করতে পারে এবং পানিপূর্ণ করতে সময় লাগে প্রায় ৮ থেকে ১০ মিনিট। আগেই বলা হয়েছে, গাতুন হ্রদের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৬ মিটার।
শাগ্রে নদী (Chagres river) হলো পানামা খালের পানির অন্যতম উৎস। এই নদীতে দুটো বাঁধ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে হ্রদটি। জাহাজগুলোকে এখানে প্রায় ৩৩ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে হয় প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে পেদ্রো মিগেল লকে পৌঁছাতে। এই হ্রদটি তৈরির সময় ৭.২ বিলিয়ন কিউবিক ফুট পাথর ও মাটি খুঁড়ে তোলা হয়, যা ছিল সুয়েজের প্রায় তিনগুণ। এগুলো পরে সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় ফেলা হয়, যেখানে বর্তমানে গড়ে উঠেছে সেনা ক্যাম্প। আটলান্টিক থেকে পানামা খাল দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করতে একটি জাহাজের সময় লাগে প্রায় ৮-১০ ঘণ্টা। এত দীর্ঘ ও যান্ত্রিক একটি জলপথ পাড়ি দিতে জাহাজগুলোকে কিন্তু উচ্চহারে শুল্ক দিতে হয়। বলা হয়ে থাকে, পানামা খালের এই শুল্কহার পৃথিবীর অন্যান্য সব জলপথের শুল্কের তুলনায় সবচেয়ে বেশি। এ কারণেই একে বলা হয় সবচেয়ে ব্যয়বহুল জলপথ। প্রায় ৮০ মিটার দীর্ঘ এই জলপথ দিয়ে বছরে প্রায় ১৪ হাজারেরও বেশি জাহাজ চলাচল করে। কিন্তু উনিশ শতকের এই খালটিকে একুশ শতকেও ব্যবহার উপযোগী ও প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখতে বেশ কিছু পরিবর্তন করতে হয়েছে। পানামা খালের এই লক সিস্টেম থাকার কারণে লকগুলোর মাপের চেয়ে জাহাজ বড় হলে তা পানামা খাল দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।
অপরদিকে, পানামার উচ্চ শুল্ক পরিশোধ সত্ত্বেও জাহাজগুলোর ধারণ ক্ষমতা তেমন বেশি না হলে জাহাজ মালিকদের লোকসান হবে। এ কারণেই ২০১৬ সালে এই লকগুলো পরিবর্তন করে এগুলো আরও বড় করা হয়। এখন ২০২০ সালে পানামা দিয়ে কোনো জাহাজ ঢুকতে চাইলে এগুলো সর্বোচ্চ ৩৬৬ মিটার লম্বা এবং ৫১ মিটার প্রস্থের হতে পারবে। এছাড়াও পানামার আরও একটি প্রধান সমস্যা হলো, এখানে জাহাজগুলোকে অতিরিক্ত পানি দিয়ে ভাসিয়ে উঁচুতে তোলা হয়। ফলে জাহাজগুলোর ওজন যদি অনেক বেশি হয়ে যায় তবে লকগুলোর ধারণক্ষমতা অনুযায়ী পানি দিলেও জাহাজগুলো কাঙ্ক্ষিত উচ্চতা পর্যন্ত ভেসে উঠবে না। এ কারণেই ২০১৬ সালে লকগুলোর গভীরতাও কিছুটা বাড়ানো হয়। আগে যেখানে চলাচলকারী জাহাজগুলোর ওজন ছিল সর্বোচ্চ ৫,০০০ TEU, বর্তমানে সর্বোচ্চ ওজন সেখানে করা হয়েছে ১৫,০০০ TEU। আর পানামা খালের এই আকৃতি বর্ধনের ফলে বর্তমানে জাহাজগুলোও বড় আকারে তৈরি করা হচ্ছে, যেগুলোকে বলা হয় নিও পানামাক্স (Neo Panamax) জাহাজ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পানামা খালের বাস্তব গুরুত্ব বোঝা যায়। সেই সময় দুই মহাসাগরের মধ্যে মিত্রশক্তির জাহাজগুলো কম সময়ে চলাচল করতে পেরেছে। কিন্তু খালের নিয়ন্ত্রণ, পানামার শ্রমিকদের সঙ্গে আচরণ ও খালের এলাকায় দুই দেশের পতাকা একই সঙ্গে ওড়ানো হবে কি না, এমন প্রশ্নে পানামা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ১৯৬৪ সালের ৯ জানুয়ারি উত্তেজনা চরমে ওঠে। সেদিন আমেরিকাবিরোধী দাঙ্গায় খাল এলাকায় বেশ কয়েকজনের মৃত্যু ঘটে। অল্প সময়ের জন্য দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কেরও ছেদ হয়। এরপর বছরের পর বছর ধরে আলোচনা শেষে প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের শাসনামলে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। ওই চুক্তিতে পানামা খালকে নিরপেক্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং বলা হয় যে সব জাহাজের জন্য এটি খোলা থাকবে। চুক্তি মোতাবেক, ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত খালের নিয়ন্ত্রণ পানামা ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যৌথভাবে থাকবে এবং এরপর তা পানামার হাতে চলে যাবে। তবে সবাই জিমি কার্টারের এই চুক্তি সমর্থন করেননি। ১৯৭৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী রোনাল্ড রেগান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ‘খালের এলাকার ন্যায়সংগত মালিক’।
পানামা খাল নিয়ে ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে আবারও দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। সে সময় পানামার প্রেসিডেন্ট ছিলেন ম্যানুয়েল নরিয়েগা। তখন ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র পানামায় সামরিক অভিযান চালায় এবং ম্যানুয়েল নরিয়েগাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। ২০০০ সালে খালের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর ওই জলপথের সক্ষমতার চেয়ে বেশি জাহাজ সেটি ব্যবহার করা শুরু করে। ২০০৭ সালে খালের বড় ধরনের সম্প্রসারণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়, যা শেষ হয় এক দশক পর। কিন্তু খালের এলাকায় ব্যাপক খরা দেখা দেওয়ায় পানির স্তর নেমে যায়, ফলে এটি পরিচালনা দুরূহ হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে কর্তৃপক্ষ জাহাজ চলাচলের সংখ্যা কমিয়ে দেয় এবং মাশুল বৃদ্ধি করে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প পানামা খাল আবার যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার কথা বলেছেন। পানামার সরকার ট্রাম্পের ওই ধারণাকে নাকচ করে দিয়েছে। পানামা খাল নিয়ে ট্রাম্পের আপত্তি দুটি। তাঁর মতে, খাল কর্তৃপক্ষ এটি ব্যবহারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ‘অত্যন্ত বেশি হারে’ মাশুল নিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে এই খালের ওপর চীনের প্রভাব ধীরে ধীরে বাড়ছে। ট্রাম্প বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র উদার হাতে যেভাবে পানামাকে সহায়তা করছে, তারপরও দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে যে হারে মাশুল নেয়, তা ‘হাস্যকর’।
পানামার প্রেসিডেন্ট হোসে রাউল মুলিনো এক বিবৃতিতে বলেছেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি নিশ্চিত করে বলতে চাই, পানামা খাল ও এর আশপাশের প্রতি বর্গমিটার পানামার সম্পত্তি এবং ভবিষ্যতেও তাই থাকবে। আমাদের দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা নিয়ে দর–কষাকষি চলবে না। ২০১৬ সালে পানামা খাল বর্ধিতকরণের রয়েছে বাটারফ্লাই ইফেক্ট। কারণ খালের ধারণক্ষমতা বেশি হওয়ায় বড় মাপের জাহাজ এখান দিয়ে চলাচল করবে। এ কারণেই বড় জাহাজগুলো যে দেশের বন্দরে গিয়ে ভিড়বে তাদের বন্দরের ধারণক্ষমতাও হতে হবে জাহাজগুলোর উপযোগী। এজন্য জলপথটি ব্যবহারকারী দেশগুলোকে তৈরি করতে হয়েছে গভীর সমুদ্রবন্দর এবং নদীপথগুলোকেও করতে হয়েছে আরো গভীর। এতকিছু সত্ত্বেও শতাব্দী প্রাচীন এই খালটির উচ্চ শুল্কহার এবং জাহাজের আকৃতির ও ওজনের বিধি-নিষেধ নিকারাগুয়াকে রাজনৈতিকভাবে উৎসাহিত করে তুলছে বিকল্প একটি জলপথ তৈরির কাজে। বেশ কয়েক বছর আগে চীনের কিছু বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানকেও বিষয়টি নিয়ে ঘাটতে দেখা গেছে। কিন্তু বিকল্প জলপথের জন্য চাই প্রচুর অর্থ, কূটনৈতিক তৎপরতা এবং প্রকৌশলীদের সঠিক নির্মাণশৈলী। তবে যতদিন এসব কিছুর একসাথে সমন্বয় না হচ্ছে ততদিন এ পানামা খাল হয়ে থাকবে এশিয়া-ইউরোপের সাথে উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার সেতুবন্ধন।