০৯:০৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১১ অক্টোবর ২০২৫

দুই বছর পর গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর, ধ্বংসস্তূপে ফিরছেন বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা

খবরের কথা ডেস্ক
  • আপডেট সময় ০৯:৩৯:৫৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১১ অক্টোবর ২০২৫
  • / 51

ছবি সংগৃহীত

 

দুই বছরের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর অবশেষে গাজায় নেমে এসেছে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা। মিসরের শারম আল শেখে অনুষ্ঠিত দীর্ঘ আলোচনার পর হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা অনুমোদনের পর শুক্রবার (১০ অক্টোবর) স্থানীয় সময় দুপুরে কার্যকর হয়।

চুক্তি অনুযায়ী, প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ইসরায়েলি বাহিনী গাজার নির্দিষ্ট কিছু এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করেছে। আর পরবর্তী ৭২ ঘণ্টায় হামাস ২০ জন ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেবে। এর বিনিময়ে ইসরায়েল ধাপে ধাপে ১ হাজার ৯৫০ জন ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেবে—যাদের মধ্যে ২৫০ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ছিল। মুক্তির তালিকায় হামাস, ফাতাহ, ইসলামিক জিহাদ ও পিএফএলপির সদস্যরাও রয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পরই গাজার দক্ষিণ, মধ্য ও উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থান থেকে সেনা ও ট্যাংক সরিয়ে নিতে দেখা গেছে। বিশেষ করে খান ইউনিস, নুসেইরাত শরণার্থীশিবির এবং উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে সেনা সরে গেছে পূর্বদিকে। তবু গাজা নগরী ও আশপাশের এলাকায় গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে, আর আকাশে দেখা মিলছে যুদ্ধবিমানের। ফলে অনেক মানুষ আশ্রয়ে ফিরেও আবার নিরাপত্তার খোঁজে স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছেন।

বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা ধ্বংসস্তূপে ফিরছেন, কারণ পালিয়ে থাকার মতো জায়গা আর নেই। কেউই জানেন না তাদের ঘরবাড়ি কবে পুনর্গঠিত হবে। স্থানীয় এক বাসিন্দা মেহেদি সাকলা বলেন, “সবকিছু শেষ হয়ে গেছে জানি, কিন্তু এ মাটিই আমাদের। পালিয়ে থাকা জীবনের চেয়ে এ কষ্টের জীবনই ভালো।”

দুই বছরের সংঘাতে গাজা প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছেন ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি এবং আহত হয়েছেন অন্তত ১ লাখ ৭০ হাজার। গাজা কর্তৃপক্ষ জানায়, ৪ লাখ ৩৬ হাজার ঘরবাড়ি পুরোপুরি ধ্বংস, যা মোট বসতঘরের প্রায় ৯২ শতাংশ। ধ্বংস হয়েছে ৫১৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ফলে প্রায় ৭ লাখ ৪৫ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা থেকে বিচ্ছিন্ন।

স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা আরও ভয়াবহ—৬৫৪টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক ক্ষতিগ্রস্ত, কৃষিজমির ৯৮ শতাংশ অনুপযোগী। জাতিসংঘের এক তদন্ত প্রতিবেদনে এই ধ্বংসযজ্ঞকে ‘জাতিগত নিধনের মতো অপরাধ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে প্রতিদিন গাজায় ৬০০ ট্রাক ত্রাণ প্রবেশের কথা রয়েছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, মিসর ও জর্ডানে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার টন ত্রাণসামগ্রী প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তবে বাস্তবে সহায়তা প্রবেশের হার অত্যন্ত সীমিত, ফলে খাদ্য ও পানির সংকট এখনো চরমে। গত দুই বছরে অনাহারে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৪৬০ জন ফিলিস্তিনি, তাদের মধ্যে ১৫৪ জন শিশু।

চুক্তি বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ডের নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক টাস্কফোর্স গঠিত হয়েছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, কাতার, মিসর ও তুরস্কসহ একাধিক দেশ অংশ নিচ্ছে। যদিও মার্কিন সেনারা গাজায় প্রবেশ করবে না বলে জানানো হয়েছে।

যুদ্ধবিরতির পরও ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। হোয়াইট হাউজ প্রকাশিত পরিকল্পনা অনুযায়ী, তিন ধাপে ইসরায়েল গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে। প্রথম ধাপে গাজার ৫৩ শতাংশ এলাকায় ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণ থাকবে, দ্বিতীয় ধাপে তা কমে ৪০ শতাংশে নামবে, তবে শেষ ধাপে গাজার ১৫ শতাংশ এলাকায় স্থায়ীভাবে ‘নিরাপত্তা অঞ্চল’ রাখার পরিকল্পনা রয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অনির্দিষ্টকালীন নিরাপত্তা অঞ্চল চুক্তির দুর্বল দিক হতে পারে। অন্যদিকে, ইসরায়েলে উগ্র ডানপন্থী রাজনীতিকদের অনেকেই যুদ্ধবিরতির বিরোধিতা করছেন। জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গাভির হুমকি দিয়েছেন, হামাস ধ্বংস না হলে তিনি জোট সরকার থেকে সরে দাঁড়াবেন।

রাজনৈতিকভাবে চাপের মুখে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি। এদিকে, ইসরায়েলি বাহিনী সরে গেলে গাজার নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে, সেটিও এখনো স্পষ্ট নয়। গাজার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা নতুন করে নিরাপত্তা বাহিনী গঠন করবে, তবে এতে হামাসের সদস্যরা থাকবে কি না, তা নির্ধারিত হয়নি।

ফিলিস্তিনি রাজনীতিক হানান আশরাউই সতর্ক করে বলেছেন, “গাজায় যুদ্ধ থামলেও, যদি পশ্চিম তীরে দখলদারি চলতে থাকে, তবে স্থায়ী শান্তি আসবে না। এখন সবচেয়ে জরুরি ফিলিস্তিনিদের ঐক্য এবং দখলদারিত্বের অবসান।”

সূত্র: রয়টার্স, আল জাজিরা

নিউজটি শেয়ার করুন

দুই বছর পর গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর, ধ্বংসস্তূপে ফিরছেন বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা

আপডেট সময় ০৯:৩৯:৫৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১১ অক্টোবর ২০২৫

 

দুই বছরের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর অবশেষে গাজায় নেমে এসেছে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা। মিসরের শারম আল শেখে অনুষ্ঠিত দীর্ঘ আলোচনার পর হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা অনুমোদনের পর শুক্রবার (১০ অক্টোবর) স্থানীয় সময় দুপুরে কার্যকর হয়।

চুক্তি অনুযায়ী, প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ইসরায়েলি বাহিনী গাজার নির্দিষ্ট কিছু এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করেছে। আর পরবর্তী ৭২ ঘণ্টায় হামাস ২০ জন ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেবে। এর বিনিময়ে ইসরায়েল ধাপে ধাপে ১ হাজার ৯৫০ জন ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেবে—যাদের মধ্যে ২৫০ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ছিল। মুক্তির তালিকায় হামাস, ফাতাহ, ইসলামিক জিহাদ ও পিএফএলপির সদস্যরাও রয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পরই গাজার দক্ষিণ, মধ্য ও উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থান থেকে সেনা ও ট্যাংক সরিয়ে নিতে দেখা গেছে। বিশেষ করে খান ইউনিস, নুসেইরাত শরণার্থীশিবির এবং উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে সেনা সরে গেছে পূর্বদিকে। তবু গাজা নগরী ও আশপাশের এলাকায় গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে, আর আকাশে দেখা মিলছে যুদ্ধবিমানের। ফলে অনেক মানুষ আশ্রয়ে ফিরেও আবার নিরাপত্তার খোঁজে স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছেন।

বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা ধ্বংসস্তূপে ফিরছেন, কারণ পালিয়ে থাকার মতো জায়গা আর নেই। কেউই জানেন না তাদের ঘরবাড়ি কবে পুনর্গঠিত হবে। স্থানীয় এক বাসিন্দা মেহেদি সাকলা বলেন, “সবকিছু শেষ হয়ে গেছে জানি, কিন্তু এ মাটিই আমাদের। পালিয়ে থাকা জীবনের চেয়ে এ কষ্টের জীবনই ভালো।”

দুই বছরের সংঘাতে গাজা প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছেন ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি এবং আহত হয়েছেন অন্তত ১ লাখ ৭০ হাজার। গাজা কর্তৃপক্ষ জানায়, ৪ লাখ ৩৬ হাজার ঘরবাড়ি পুরোপুরি ধ্বংস, যা মোট বসতঘরের প্রায় ৯২ শতাংশ। ধ্বংস হয়েছে ৫১৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ফলে প্রায় ৭ লাখ ৪৫ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা থেকে বিচ্ছিন্ন।

স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা আরও ভয়াবহ—৬৫৪টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক ক্ষতিগ্রস্ত, কৃষিজমির ৯৮ শতাংশ অনুপযোগী। জাতিসংঘের এক তদন্ত প্রতিবেদনে এই ধ্বংসযজ্ঞকে ‘জাতিগত নিধনের মতো অপরাধ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে প্রতিদিন গাজায় ৬০০ ট্রাক ত্রাণ প্রবেশের কথা রয়েছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, মিসর ও জর্ডানে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার টন ত্রাণসামগ্রী প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তবে বাস্তবে সহায়তা প্রবেশের হার অত্যন্ত সীমিত, ফলে খাদ্য ও পানির সংকট এখনো চরমে। গত দুই বছরে অনাহারে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৪৬০ জন ফিলিস্তিনি, তাদের মধ্যে ১৫৪ জন শিশু।

চুক্তি বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ডের নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক টাস্কফোর্স গঠিত হয়েছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, কাতার, মিসর ও তুরস্কসহ একাধিক দেশ অংশ নিচ্ছে। যদিও মার্কিন সেনারা গাজায় প্রবেশ করবে না বলে জানানো হয়েছে।

যুদ্ধবিরতির পরও ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। হোয়াইট হাউজ প্রকাশিত পরিকল্পনা অনুযায়ী, তিন ধাপে ইসরায়েল গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে। প্রথম ধাপে গাজার ৫৩ শতাংশ এলাকায় ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণ থাকবে, দ্বিতীয় ধাপে তা কমে ৪০ শতাংশে নামবে, তবে শেষ ধাপে গাজার ১৫ শতাংশ এলাকায় স্থায়ীভাবে ‘নিরাপত্তা অঞ্চল’ রাখার পরিকল্পনা রয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অনির্দিষ্টকালীন নিরাপত্তা অঞ্চল চুক্তির দুর্বল দিক হতে পারে। অন্যদিকে, ইসরায়েলে উগ্র ডানপন্থী রাজনীতিকদের অনেকেই যুদ্ধবিরতির বিরোধিতা করছেন। জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গাভির হুমকি দিয়েছেন, হামাস ধ্বংস না হলে তিনি জোট সরকার থেকে সরে দাঁড়াবেন।

রাজনৈতিকভাবে চাপের মুখে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি। এদিকে, ইসরায়েলি বাহিনী সরে গেলে গাজার নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে, সেটিও এখনো স্পষ্ট নয়। গাজার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা নতুন করে নিরাপত্তা বাহিনী গঠন করবে, তবে এতে হামাসের সদস্যরা থাকবে কি না, তা নির্ধারিত হয়নি।

ফিলিস্তিনি রাজনীতিক হানান আশরাউই সতর্ক করে বলেছেন, “গাজায় যুদ্ধ থামলেও, যদি পশ্চিম তীরে দখলদারি চলতে থাকে, তবে স্থায়ী শান্তি আসবে না। এখন সবচেয়ে জরুরি ফিলিস্তিনিদের ঐক্য এবং দখলদারিত্বের অবসান।”

সূত্র: রয়টার্স, আল জাজিরা